Pages

Ads 468x60px

Social Icons

Featured Posts

Wednesday 9 April 2014

বেদেনী ( ছোটগল্প ) - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় / BEDENI by Tarashankar Bandyopadhyay

 


ছোট গল্প
বেদেনী
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
শম্ভু বাজিকর এ মেলায় প্রতি বৎসর আসে।
তাহার বসিবার স্থানটা মা কঙ্কালীর
এস্টেটের
খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
মতো কায়েমি হইয়া গিয়াছে। লোকে বলে,
বাজি; কিন্তু শম্ভু বলে ‘ভোজবাজি-ছারকাছ’।
ছোট তাঁবুটার প্রবেশপথের মাথার উপরেই
কাপড়ে আঁকা একটা সাইনবোর্ডেও
লেখা আছে ‘ভোজবাজি-সার্কাস’। লেখাটার
একপাশে একটা বাঘের ছবি,
অপরদিকে একটা মানুষ, তাহার এক
হাতে রক্তাক্ত তরবারি, অপর
হাতে একটি ছিন্নমুণ্ডু। প্রবেশমূল্য মাত্র
দুইটি পয়সা। ভিতরে আছে কিন্তু ‘গোলকধামে’র
খেলা। ভিতরে পট টাঙাইয়া কাপড়ের পর্দায়
শম্ভু
মোটা লেন্স লাগাইয়া দেয়,
পল্লীবাসীরা বিমুগ্ধ
বিস্ময়ে সেই লেন্সের মধ্যে দিয়া দেখে ‘আংরেজ
লোকের যুদ্ধ,’ ‘দিল্লীকা বাদশা’,
‘কাবুলকে পাহাড়’, ‘তাজ-বিবিকা কবর’। তারপর
শম্ভু লোহার রিং লইয়া খেলা দেখায়,
সর্বশেষে একটা পর্দা ঠেলিয়া দিয়া দেখায়
খাঁচায়
বন্দি একটা চিতাবাঘ।
বাঘটাকে বাহিরে আনিয়া তাহার উপরে শম্ভুর
স্ত্রী রাধিকা বেদেনী চাপিয়া বসে, বাঘের
সম্মুখের
থাবা দুইটা ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া আপন
ঘাড়ের উপর চাপাইয়া তাহার সহিত
মুখোমুখি দাঁড়াইয়া বাঘের চুমা খায়,
সর্বশেষে বাঘটার মুখের ভিতর আপনার প্রকাণ্ড
চুলের খোঁপাটা পুরিয়া দেয়, মনে হয়, মাথাটাই
বাঘের মুখের মধ্যে পুরিয়া দিল। সরল
পল্লীবাসীরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে নিশ্বাস রুদ্ধ
করিয়া দেখিতে দেখিতে করতালি দিয়া উঠে।
তাহার পরেই খেলা শেষ হয়, দর্শকের দল বাহির
হইয়া যায়, সর্বশেষ দর্শকটির সঙ্গে শম্ভুও
বাহির হইয়া আসিয়া আবার তাঁবুর
দুয়ারে জয়ঢাক
পিটিতে থাকে–দুম-দুম, দুম। জয়ঢাকের
সঙ্গে স্ত্রী রাধিকা বেদেনী প্রকাণ্ড
একজোড়া করতাল বাজায়–ঝন- ঝন-ঝন।
মধ্যে মধ্যে শম্ভু হাঁকে, বড় বাঘ! এ বড় বা-ঘ।
–পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের চুমা খায়,
জ্যান্ত মানুষের মাথা মুখের মধ্যে পোরে, কিন্তু
খায় না।
কথাগুলো শেষ করিয়াই
সে ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে একটা তীক্ষ্নাগ্র
অঙ্কুশ দিয়া খোঁচা মারে,
সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা বার বার গর্জন
করিতে থাকে। তাঁবুর দুয়ারের সম্মুখে সমবেত
জনতা ভীতিপূর্ণ কৌতূহলস্পন্দিত বক্ষে তাঁবুর
দিকে অগ্রসর হয়।
দুয়ারের
পাশে দাঁড়াইয়া বেদেনী দুইটি করিয়া পয়সা লইয়া তবে প্রবেশ
করিতে দেয়। এ ছাড়াও বেদেনীর নিজের খেলাও
আছে। তাহার আছে একটা ছাগল, বাঁদর আর
গোটাকয়েক সাপ। সকাল হইতেই সে আপনার
ঝুলি-ঝাঁপি লইয়া গ্রামে বাহির হয়, গৃহস্থের
বাড়ি বাড়ি খেলা দেখাইয়া, গান
গাহিয়া উপার্জন
করিয়া আনে।
এবার শম্ভু কঙ্কালীর মেলায় আসিয়া ভীষণ
ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। কোথা হইতে আর
একটা বাজির তাঁবু আসিয়া বসিয়া গিয়াছে।
তাহার
জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটা অবশ্য খালিই
পড়িয়া আছে, কিন্তু এ বাজির তাঁবুটা অনেক বড়
এবং কায়দাকরণেও অনেক অভিনবত্ব আছে।
বাহিরে দুইটা ঘোড়া, একটা গরুর গাড়ির উপর
প্রকাণ্ড একটা খাঁচা, নিশ্চয় উহাতে বাঘ আছে।
গরুর গাড়ি তিনখানা নামাইয়া শম্ভু নূতন তাঁবুর
দিকে মর্মান্তিক ঘৃণায় হিংস্র দৃষ্টিতে চাহিল,
তারপর আক্রোশভরা নিম্নকণ্ঠে বলিল, শালা!
তাহার মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। শম্ভুর সমগ্র
আকৃতির মধ্যে একটা নিষ্ঠুর হিংস্র ছাপ যেন
মাখানো আছে। ক্রূর নিষ্ঠুরতা পরিব্যঞ্জক
একধারার উগ্র তামাটে রং আছে–শম্ভুর দেহবর্ণ
সেই উগ্র তামাটে; আকৃতি দীর্ঘ,
সর্বাঙ্গে একটা শ্রীহীন কঠোরতা,
মুখে কপালের নিচেই নাকে একটা খাঁজ, সাপের
মতো ছোট ছোট গোল চোখ, তাহার উপর
সে দন্তু, সম্মুখের দুইটা দাঁত কেমন বাঁকা হিংস্র
ভঙ্গিতে অহরহ বাহিরে জাগিয়া থাকে। হিংসায়,
ক্রোধে সে যেন ভয়াবহ হইয়া উঠিল।
রাধিকাও হিংসায়, ক্রোধে, ধারালো ছুরি যেমন
আলোকের স্পর্শে চকমক করিয়া উঠে, তেমনই
ঝকমক করিয়া উঠিল, সে বলিল, দাঁড়া খাঁচায় দিব
গোক্ষুরার ডেঁকা ছেড়্যা!
রাধিকার উত্তেজনার স্পর্শে শম্ভু
আরো উত্তেজিত হইয়া উঠিল, সে ক্রুদ্ধ দীর্ঘ
পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া নূতন তাঁবুটার ভিতর
ঢুকিয়া বলিল, কে বেটে, মালিক কে বেটে?
–কি চাই?–তাঁবুর ভিতরের আর একটা ঘরের
পর্দা ঠেলিয়ে বাহির হইয়া আসিল
একটি জোয়ান পুরুষ, ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা,
শরীরের প্রতি অবয়বটি সবল এবং দৃঢ়, কিন্তু
তবুও দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়,
লম্বা হাল্কা দেহ, তাজা ঘোড়া যেমন
একটি মনোরম লাবণ্যে ঝকমক করে–লোকটির
হাল্কা অথচ সবল দৃঢ় শরীরে তেমনই
একটি লাবণ্য আছে। রং কালোই,
নাকটি লম্বা টিকালো, চোখ দুইটি সাধারণ,
পাতলা ঠোঁট দুইটির উপর
তুলি দিয়া আঁকা গোঁফের মতো এক
জোড়া গোঁফ-সূচাগ্র করিয়া পাক দেওয়া, মাথায়
বাবরি চুল, গলায় ঝুলানো একটি সোনার ছোট
চৌকা তক্তি,–সে আসিয়া শম্ভুর
সম্মুখে দাঁড়াইল! দুজনেই দুইজনকে দেখিতেছিল।
–কি চাই?–নূতন বাজিকর আবার প্রশ্ন করিল,
কথার সঙ্গে সঙ্গে মদের গন্ধে শম্ভুর নাকের
নিচের বায়ুস্তর ভুরভুর করিয়া উঠিল।
শম্ভু খপ করিয়া ডান হাত দিয়া তাহার
বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিল, বলিল, এ
জায়গা আমার।
আমি আজ পাঁচ বৎসর এইখানে বসছি।
ছোকরাটিও খপ করিয়া আপন ডান হাতে শম্ভুর
বাঁ হাত চাপিয়া ধরিয়া মাতালের হাসি হাসিল,
বলিল, সে হবে, আগে মদ খাও টুকটা।
শম্ভুর পিছনে জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রে দ্রুততম
গতিতে যেন গৎ বাজিয়া উঠিল, রাধিকা কখন
আসিয়া শম্ভুর পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, সে খিল
খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, কটি বোতল
আছে তুমার নাগর–মদ খাওয়াইবা?
ছোকরাটি শম্ভুর মুখ হইতে পিছনের
দিকে চাহিয়া রাধিকাকে দেখিয়া বিস্ময়ে মোহে কথা হারাইয়া নির্বাক
হইয়া গেল। কালো সাপিনীর মতো ক্ষীণতনু
দীর্ঘাঙ্গিনী বেদেনীর সর্বাঙ্গে যেন
মাদকতা মাখা; তাহার ঘন কুঞ্চিত কালো চুলে,
চুলের মাঝখানে সাদা সুতার মতো সিঁথিতে,
তাহার ঈষৎ বঙ্কিম নাকে, টাকা অর্ধ-নিমীলিত
ভঙ্গির মদিরদৃষ্টি দুটি চোখে,
সূচালো চিবুকটিতে–সর্বাঙ্গে মাদকতা। সে যেন
মদিরার সমুদ্রে সদ্য স্নান করিয়া উঠিল;
মাদকতা তাহার সর্বাঙ্গ
বাহিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। মহুয়াফুলের গন্ধ
যেমন নিশ্বাসে ভরিয়া দেয় মাদকতা, বেদেনীর
কালো রূপও চোখে তেমনই একটা ধরাইয়া দেয়
নেশা। শুধু রাধিকাই নয়, এই বেদেজাতের মেয়েদের
এটা একটা জাতিগত রূপবৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য
রাধিকার রূপের মধ্যে একটা যেন প্রতীকের
সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু মোহময় মাদকতার
মধ্যে আছে ক্ষুরের মতো ধার, মোহমত্ত
পুরুষকেও থমকিয়া দাঁড়াইতে হয়, মোহের
মধ্যে ভয়ের চেতনা জাগাইয়া তোলে,
বুকে ধরিলে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন
হইয়া যাইবে।
রাধিকার খিল খিল হাসি থামে নাই, সে নূতন
বাজিকরের বিস্ময়বিহ্বল নীরব
অবস্থা দেখিয়া আবার বলিল, বাক হর্যা গেল
যে নাগরের?
বাজিকর এবার হাসিয়া বলিল, বেদের
বাচ্চা গো আমি। বেদের ঘরের মদের অভাব!
এস। কথা সত্য, এই অদ্ভুত জাতটি মদ কখন
কিনিয়া খায় না। উহারা লুকাইয়া চোলাই করে,
ধরাও পড়ে, জেলেও যায়। কিন্তু
তা বলিয়া স্বভাব কখন ছাড়ে না। শাসন-
বিভাগের নিকট পর্যন্ত ইহাদের এ
অপরাধটা অতি সাধারণ হিসাবে লঘু
হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
শম্ভুর
বুকখানা নিশ্বাসে ভরিয়া এতখানি হইয়া উঠিল।
আহ্বানকারীও তাহার স্বজাতি, নতুবা–।
সে রাধিকার দিকে ফিরিয়া কঠিন
দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, তুই আইলি কেনে এখেনে?
রাধিকা এবারও খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল,
মরণ তুমার! আমি মদ খাব নাই?
তাঁবুর ভিতরে ছোট একটা প্রকোষ্ঠের
মধ্যে মদের আড্ডা বসিল। চারদিকে পাখির
মাংসের টুকরা টুকরা হাড়ের কুচি ও
একরাশি মুড়ি ছড়াইয়া পড়িয়া আছে;
একটা পাতায় এখনও খানিকটা মাংস, আর
একটায়
কিছু মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কা, খানিকটা নুন,
দুইটি খালি বোতল গড়াইতেছে, একটা বোতল
অর্ধসমাপ্ত। বিস্রস্তবসনা একটি বেদের
মেয়ে পাশেই নেশায় অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে,
মাথার চুল ধুলায় রুক্ষ, হাত দুইটি মাথার উপর
দিয়া ঊর্ধ্ববাহুর ভঙ্গিতে মাটির উপর লুণ্ঠিত,
মুখে তখনও মদের ফেনা বুদ্বুদের
মতো লাগিয়া রহিয়াছে। হৃষ্টপুষ্ট শান্তশিষ্ট
চেহারার মেয়েটি।
রাধিকা তাহাকে দেখিয়া আবার খিল খিল
করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তুমার বেদেনী? ই
যি কাটা কলাগাছের পারা পড়েছে গো!
নূতন বাজিকর হাসিল, তারপর
সে স্খলিতপদে খানিকটা অগ্রসর
হইয়া একটা স্থানের
আলগা মাটি সরাইয়া দুইটা বোতল বাহির
করিয়া আনিল।
মদ খাইতে খাইতে কথা যাহা বলিবার বলিতেছিল
নূতন বাজিকর আর রাধিকা।
শম্ভু মত্ততার মধ্যেও গম্ভীর
হইয়া বসিয়া ছিল। প্রথম পাত্র পান করিয়াই
রাধিকা বলিল, কি নাম গো তুমার বাজিকর?
নূতন বাজিকর
কাঁচা লঙ্কা খানিকটা দাঁতে কাটিয়া বলিল,
নাম
শুনলি গালি দিবা আমাকে বেদেনী।
–কেনে?
–নাম বটে কিষ্টো বেদে।
–তা গালি দিব কেনে?
–তুমার নাম যে রাধিকা বেদেনী, তাই বুলছি।
রাধিকা খিল খিল
করিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল।
পরক্ষণেই সে কাপড়ের ভিতর
হইতে ক্ষিপ্রহস্তে কি বাহির করিয়া নূতন
বাজিকরের গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, কই,
কালিয়দমন কর দেখি কিষ্টো, দেখি!
শম্ভু চঞ্চল হইয়া পড়িল; কিন্তু
কিষ্টো বেদে ক্ষিপ্র হাতে আঘাত
করিয়া সেটাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল।
একটা কালো কেউটের বাচ্চা। আহত সর্পশিশু
হিস গর্জন করিয়া ফণা তুলিয়া দংশনোদ্যত
হইয়া উঠিল : শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, আ-
কামা! অর্থাৎ বিষ দাঁত এখনও ভাঙা হয় নাই।
কিষ্টো কিন্তু ততক্ষণে তাহার
মাথাটা বাঁ হাতে চাপিয়া ধরিয়া হাসিতে আরম্ভ
করিয়া দিয়াছে। হাসিতে হাসিতে সে ডান
হাতে ট্যাঁক হইতে ছোট একটা ছুরি বাহির
করিয়া দাঁত দিয়া খুলিয়া ফেলিল এবং সাপটার
বিষদাঁত ও বিশেষ থলি দুইই
কাটিয়া ফেলিয়া রাধিকার গায়ে আবার
ছুড়িয়া দিল। রাধিকাও
বাঁ হাতে সাপটাকে ধরিয়া ফেলিল; কিন্তু
রাগে সে মুহূর্ত পূর্বের ঐ সাপটার মতোই
ফুলিয়া উঠিল, বলিল–আমার সাপ
তুমি কামাইলা কেনে?
কিষ্টো বলিল, তুমি যে বলল্যা গো দমন
করতে।–বলিয়া সেও একবার
হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
রাধিকা মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া তাঁবু
হইতে বাহির হইয়া গেল।
সন্ধ্যার পূর্বেই।
নূতন তাঁবুতে আজ হইতেই খেলা দেখানো হইবে,
সেখানে সমারোহ পড়িয়া গিয়াছে।
বাহিরে মাচা বাঁধিয়া সেটার উপর
বাজনা বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে,
একটা প্রেট্রোম্যাঙ্ আলো জ্বালিবার উদ্যোগ
হইতেছে। রাধিকা আপনাদের ছোট তাঁবুটির
বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের খেলার
তাঁবু
এখনও খাটানো হয় নাই। রাধিকার চোখ
দুইটি হিংস্রভাবে যেন জ্বলিতেছিল।
শম্ভু নিকটেই একটা গাছতলায় নামাজ
পড়িতেছিল; আরও একটু দূরে আর একটা গাছের
পাশে নামাজ পড়িতেছিল কিষ্টো। বিচিত্র জাত
বেদেরা। জাতি জিজ্ঞাসা করিলে বলে, বেদে।
তবে ধর্মে ইসলাম। আচারে পুরা হিন্দু,
মনসাপূজা করে, মঙ্গলচণ্ডী, যষ্ঠীর ব্রত করে,
কালী দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করে, নাম
রাখে শম্ভু শিব কৃষ্ণ হরি,
কালী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী। হিন্দু পুরাণ
কথা ইহাদের কণ্ঠস্থ। এমনই
আরো একটি সম্প্রদায় পট দেখাইয়া হিন্দু
পৌরাণিক গান করে, তাহারা নিজেদের
বলে পটুয়া,
পট তাহারা নিজেরাই আঁকে। বিবাহ আদান
প্রদান সমগ্রভাবে ইসলাম ধর্মসম্প্রদায়ের
সঙ্গে হয় না, নিজেদের এই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের
মধ্যেই আবদ্ধ। বিবাহ হয় মোল্লার নিকট
ইসলামীয় পদ্ধতিতে, মরিলে পোড়ায় না, কবর
দেয়। জীবিকায় বাজিকর, সাপ ধরে, সাপ
নাচাইয়া গান করে, বাঁদর ছাগল
লইয়া খেলা দেখায়, অতি সাহসী কেহ কেহ
এমনই তাঁবু খাটাইয়া বাঘ লইয়া খেলা দেখায়।
কিন্তু এই নূতন তাঁবুর মতো সমারোহ
করিয়া তাহাদের সম্প্রদায়ের কেহ কখন
খেলা দেখায় নাই। রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল
আসিতেছিল। তাহার মনশ্চক্ষে কেবল
ভাসিয়া উঠিতেছিল উহাদের সবল তরুণ বাঘটির
কথা। ইহার মধ্যে লুকাইয়া সে বাঘটাকে কাঠের
ফাঁক দিয়া দেখিয়া আসিয়াছে। সবল দৃঢ়
ক্ষিপ্রতাব্যঞ্জক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চকচকে চিকন
লোম, মুখে হিংস্র হাসির মতো ভঙ্গি যেন
অহরহই লাগিয়া আছে! আর তাহাদের
বাঘটা স্থবির শিথিলদেহ, কর্কশলোম,
খসখসে লোমগুলো দেখিলে রাধিকার শরীর
ঘিনঘিন করিয়া উঠে। কতবার
সে শম্ভুকে বলিয়াছে একটা নূতন বাঘ কিনিবার
জন্য, কিন্তু শম্ভুর যে কি মমতা ঐ বাঘটির
প্রতি, যাহার হেতু সে কিছুতেই খুঁজিয়া পায় না।
নামাজ সারিয়া শম্ভু আসিতেই সে গভীর ঘৃণা ও
বিরক্তির সহিত বলিয়া উঠিল, তুর ঐ
বুড়া বাঘের খেলা কেউ দেখতে আসবে নাই।
ক্রুদ্ধস্বরে শম্ভু বলিল, তু জানছিস সব!
রাধিকা নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া কহিল,
না জেনে না আমি! তু-ই জানছিস সব!
শম্ভু চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু রাধিকা থামিল
না, কয়েক মুহূর্ত চুপ
করিয়া থাকিয়া সে বলিয়া উঠিল, ওরে মড়া,
বুড়ার
নাচন দেখতে কার কবে ভালো লাগে রে?
আমারে বলে, তু জানছিস সব!
শম্ভু মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল,
পরিপূর্ণভাবে তাহার সিংস্র দুই পাটি দাঁত ঐ
বাঘের ভঙ্গিতেই বাহির করিয়া সে বলিল,
ছোকরার উপর বড় টান দেখি তুর!
রাধিকা সর্পিণীর মতো গর্জন করিয়া উঠিল,
কি বুললি বেইমান?
শম্ভু আর কোনো কথা বলিল না, অঙ্কুশভীত
মাঘের মতো ভঙ্গিতেই সেখান
হইতে চলিয়া গেল।
ক্রোধে অভিমানে রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল
আসিল। বেইমান তাহাকে এতবড়
কথাটা বলিয়া গেল? সব ভুলিয়া গিয়াছে সে?
নিজের বয়সটাও তাহার মনে নাই? চলি্লশ
বৎসরের পুরুষ, তুই তো বুড়া! রাধিকার বয়সের
তুলনায় তুই বুড়া ছাড়া আর কি? রাধিকা এই
সবে বাইশে পা দিয়েছে।
সে কি দায়ে পড়িয়া শম্ভুকে বরণ করিয়াছে?
রাধিকা তাড়াতাড়ি আপনাদের তাঁবুর
ভিতরে ঢুকিয়া গেল।
সত্য কথা। সে আজ পাঁচ বৎসর আগের ঘটনা।
রাধিকার বয়স তখন সতেরো। তাহারও তিন
বৎসর পূর্বে শিবপদ বেদের সহিত তাহার বিবাহ
হইয়াছিল। শিবপদ ছিল রাধিকার চেয়ে বৎসর
তিনেকের বড়। আজও তাহার
কথা মনে করিয়া রাধিকার দুঃখ হয়। শান্ত
প্রকৃতির মানুষ, কোমল মুখশ্রী, বড় বড় চোখ,
সে চোখের দৃষ্টি যেন মায়াবীর দৃষ্টি! সাপ,
বাঁদর, ছাগল এ সবে তাহার আসক্তি ছিল না।
সে করিত বেতের কাজ, ধামা বুনিত, চেয়ার
পাল্কির ছাউনি করিত, ফুলের সৌখিন
সাজি তৈয়ারি করিত, তাহাতে তাহার উপার্জন
ছিল গ্রামের সকলের চেয়ে বেশি।
তাহারা স্বামী-
স্ত্রীতে বাহির হইত, সে কাঁধে ভার
বহিয়া লইয়া যাইত তাহার বেতের জিনিস;
রাধিকা লইয়া যাইত তাহার সাপের ঝাঁপি,
বাঁদর,
ছাগল। শিবপদর সঙ্গে আরো একটি যন্ত্র
থাকিত, তাহার কোমরে গোঁজা থাকিত বাঁশের
বাঁশি। রাধিকা যখন সাপ নাচাইয়া গান
গাহিত,
শিবপদ রাধিকার স্বরের সহিত
মিলাইয়া বাঁশি বাজাইত। ইহা ছাড়াও শিবপদর
আর একটা কত বড় গুণ ছিল। তাহাদের সামাজিক
মজলিসে বৃদ্ধদের আসরেও তাহার ডাক পড়িত।
অতি ধীর প্রকৃতির লোক শিবপদ
এবং লেখাপড়াও কিছু কিছু নিজের চেষ্টায়
শিখিয়াছিল, এই জন্য তাহার পরামর্শ
প্রবীণরাও গ্রহণ করিত। গ্রামের মধ্যে সম্মান
কত তাহার! আর সেই শিবপদ ছিল রাধিকার
ক্রীতদাসের মতো। টাকা-কড়ি সব থাকিত
রাধিকার কাছে। তাঁতে বোনা কালো রঙের
জমির উপর সাদা সুতার খুব ঘন ঘন
ঘরকাটা শাড়ি পরিতে রাধিকা খুব ভালোবাসিত,
শিবপদ বারো মাস সেই কাপড়ই
তাহাকে পরাইয়াছে।
এই সময় কোথা হইতে দশ বৎসর নিরুদ্দেশ
থাকার পর আসিল এই শম্ভু, সঙ্গে এই বাঘটা,
একটা ছেঁড়া তাঁবু, আর এক
বিগতযৌবনা বেদেনী।
বাঘ ও তাঁবু দেখিয়া সকলের তাক লাগিয়া গেল।
প্রথম যেদিন রাধিকা শম্ভুকে দেখিল, সেই
দিনের কথা আজও তাহার মনে আছে! সে এই
উগ্র পিঙ্গলবর্ণ, উদ্ধতদৃষ্টি, কঠোর বলিষ্ঠ
দেহ মানুষটিকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল।
শম্ভু তাহাকে দেখিতেছিল মুগ্ধ বিস্ময়ের সহিত;
সেই প্রথম ডাকিয়া বলিল, এই বেদেনী, দেখি তুর
সাপ কেমন?
রাধিকার কি যে হইয়াছিল, সে ফিক
করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল, নাগরের সখ
যে দেখি খুব! পয়সা দিবা?
বেশ মনে আছে, শম্ভু বলিয়াছিল, পয়সা দিব না,
তু সাপ দেখাবে আমি বাঘ দেখাব। বাঘ!
রাধিকা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল।
কে লোকটা? যেমন অদ্ভুত চেহারা;
তেমনি অদ্ভুত কথা; বলে বাঘ দেখাইবে!
সে তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ন
দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়াছিল, সত্যি বলছ?
বেশ, দেখ, আগে আমার বাঘ দেখ!
সে তাহাকে তাঁবুর ভিতরে লইয়া গিয়া সত্যই বাঘ
দেখাইয়াছিল। রাধিকা সবিস্ময়ে তাহাকে প্রশ্ন
করিয়াছিল, ই বাঘ নিয়া তুমি কি কর?
লড়াই করি, খেলা দেখাই।
হাঁ?
হাঁ, দেখবি তু?–বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই
খাঁচা খুলিয়া বাঘটাকে বাহির করিয়া তাহার
সামনের দুই থাবা দুই হাতে ধরিয়া তুলিয়া বাঘের
সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছিল। বেশ মনে আছে,
রাধিকা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিল। শম্ভু
বাঘটাকে খাঁচায় ভরিয়া রাধিকার
সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিল, তু এইবার সাপ
দেখা আমাকে!
রাধিকা সে কথার উত্তর দেয় নাই, বলিয়াছিল,
উটা তুমার পোষ মেনেছে?
হি হি করিয়া হাসিয়া শম্ভু
সবলে তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, হিঁ,
বাঘিনী পোষ মানাইতে আমি ওস্তাদ আছি।
কি যে হইয়াছিল রাধিকার এক বিন্দু
আপত্তি পর্যন্ত করে নাই। দিনকয়েক পরেই
সে শিবপদর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ লইয়া সম্ভুর
তাঁবুতে উঠিয়াছিল। শিবপদর চোখের জলে বুক
ভাসিয়া গিয়াছিল, কিন্তু রাধিকার
মমতা হওয়া দূরের কথা, লজ্জা হওয়া দূরে থাক,
ঘৃণায় বীতরাগে তাহার অন্তর রি-
রি করিয়া উঠিয়াছিল। রাধিকার মা-বাপ,
গ্রামের
সকলে তাহাকে ছি-ছি করিয়াছিল, কিন্তু
রাধিকা সে গ্রাহ্যই করে নাই।
সেই রাধিকার আনীত অর্থে শম্ভুর এই তাঁবু ও
খেলার অন্য সরঞ্জাম কেনা হইয়াছিল, সে অর্থ
আজ নিঃশেষিত হইয়া আসিয়াছে, দুঃখেই দিন
চলে আজকাল, শম্ভু যাহা রোজগার করে, সবই
নেশায় উড়াইয়া দেয়, কিন্তু রাধিকা একটি দিনের
জন্যেও দুঃখ করে নাই। আর সেই বেইমান
কিনা এই কথা বলিল? সে একটা মদের বোতল
বাহির করিয়া বসিল।
ওদিকে নূতন তাঁবুতে আবার বাজনা বাজিতেছে!
দোসরা দফায় খেলা আরম্ভ হইবে। মদ
খাইয়া রাধিকা হিংস্র হইয়া উঠিয়াছিল, ঐ
বাজনার শব্দে তাহার সমস্ত অন্তরটা যেন রি-
রি করিয়া উঠিল। উহাদের তাঁবুতে নিশীথ
রাত্রে আগুন ধরাইয়া দিলে কেমন হয়?
সহসা তাহাদের তাঁবুর বাহিরে শম্ভুর ক্রুদ্ধ উচ্চ
কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে মত্ততার উপর উত্তেজিত
হইয়া বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, শম্ভুর
সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিষ্টো। তাহার
পরনে ঝকঝকে সাজ-পোশাক, চোখ রাঙ্গা, সেই
তখন কথা বলিতেছিল, কেনে,
ইথে দোষটা কি হলো? তুমরা ব’সে রইছ,
আমাগোর খেলা হচ্ছে। খেলা দেখবার
নেওতা দিলাম, তা দোষটা কি হলো?
শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, খেল দেখাবেন
খেলোয়াড়ি আমার! অপমান করতে আসছিস ত!
কিষ্টো কি বলিতে গেল, কিন্তু তাহার পূর্বেই
উত্তেজিত রাধিকা একটা ইট
কুড়াইয়া লইয়া সজোরে তাহাকে লক্ষ্য
করিয়া মারিয়া বসিল। অব্যর্থ লক্ষ্য, কিন্তু
কিষ্টো অদ্ভুত, সে বলের
মতো সেটাকে লুফিয়া ধরিয়া ফেলিল, তাহার পর
ইটটাকে লুফিতে লুফিতে চলিয়া গেল।
রাধিকা বিস্ময়ে সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত যেন
স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল, সে ঘোর
কাটাইতে সে বর্ধিত উত্তেজনায় আবার
একটা ইট কুড়াইয়া লইল; কিন্তু শম্ভু
তাহাকে নিবৃত্ত করিল, সে সাদরে তাহার হাত
ধরিয়া তাঁবুর মধ্যে লইয়া গেল। রাধিকা বিপুল
আবেগে শম্ভুর
গলা জড়াইয়া ধরিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে আরম্ভ
করিল।
শম্ভু বলিল, এই মেলার বাদেই বাঘ
কিনে লিয়ে আসব।
ওদিকের তাঁবু হইতে কিষ্টোর কণ্ঠস্বর
ভাসিয়া আসিল, খোল কানাৎ, ফেলে দে খুল্যে।
তাঁবুর একটা ছেঁড়া ফাঁক দিয়া রাধিকা দেখিল,
তাঁবুর কানাৎ খুলিয়া দিতেছে, অর্থাৎ
ভিতরে না গেলেও তাহারা যেন দেখিতে বাধ্য হয়।
সে ক্রোধে গর্জন করিয়া উঠিল, দিব আগুন
ধরাইয়া তাঁবুতে।
শম্ভু গম্ভীর হইয়া ভাবিতেছিল। কিষ্টো চলন্ত
ঘোড়ার পিঠে দাঁড়াইয়া কসরৎ দেখাইতেছে।
রাধিকা একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস
ফেলিয়া বলিল, নতুন খেলা কিছু বার কর তুমি,
নইলে বদনামি হবে, কেউ
দেখবে না খেলা আমাগোর।
শম্ভু দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, কাল
পুলিশে ধরাইয়া দিব শ্যালাকে। মদের সন্ধান
দিয়া দিব।
ওদিকে টিয়াপাখিতে কামান দাগিল, সেই
মেয়েটা তারের উপর ছাতা মাথায় দিয়া নাচিল,
বাঘটার সহিত কিষ্টো লড়াই করিল, ইঃ–
একটা থাবা বসাইয়াছে বাঘটা।
রাধিকা আপনাদের খেলার দৈন্যের
কথা ভাবিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল!
সঙ্গে সঙ্গে আক্রোশও ফুলিতেছিল।
তাঁবুটা আগুন ধরিয়া ধু-ধু করিয়া জ্বলিয়া যায়!
কেরোসিন তেল ঢালিয়া আগুন
ধরাইয়া দিলে কেমন হয়?
পরদিন সকালে উঠিয়া রাধিকার একটু
দেরি হইয়া গিয়াছিল : উঠিয়া দেখিল শম্ভু নাই;
সে বোধ হয় দুই চারজন মজুরের
সন্ধানে গ্রামে গিয়াছে।
বাহিরে আসিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
কিষ্টোর তাঁবুর চারিপাশে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছে।
দুয়ারে একজন দারোগা বসিয়া আছেন। এ কি?
সে সটান গিয়া দারোগার সামনে সেলাম
করিয়া দাঁড়াইল। দারোগা তাহার আপাদমস্তক
দেখিয়া বলিলেন, ডাক সব, আমরা তাঁবু দেখব।
আবার সেলাম করিয়া বেদেনী বলিল, কি কসুর
করলাম হুজুর?
–মদ আছে কিনা দেখব আমরা। ডাক
বেটাছেলেদের। এইখান থেকেই ডাক।
রাধিকা বুঝিল, দারোগা তাহাকে এই তাঁবুরই
লোক ভাবিয়াছেন, কিন্তু সে আর তাঁহার ভুল
ভাঙিল না। সে বলিল, ভিতরে আমার
কচি ছেলে রইছে হুজুর–
–আচ্ছা ছেলে নিয়ে আসতে পার তুমি। আর
ডেকে দাও পুরুষদের।
রাধিকা দ্রুত তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই
দেখা জায়গাটার আলগা মাটি সরাইয়া দেখিল,
তিনটা বোতল তখনও মজুদ রহিয়াছে।
সে একখানা কাপড় টানিয়া লইয়া ভাঁজ
করিয়া বোতল তিনটাকে পুরিয়া ফেলিল,
সুকৌশলে এমন করিয়া বুকে ধরিল শীতের
দিনে সযত্নে বস্ত্রাবৃত অত্যন্ত কচি শিশু
ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাঁবুর মধ্যেই
কিষ্টো অঘোরে ঘুমাইতেছিল, পায়ের
ঠেলা দিয়া তাহাকে জাগাইয়া দিয়া রাধিকা বলিল,
পুলিশ আসছে, ব’সে রইছে দুয়ারে উঠ্যা যাও।
সে অকল্পিত সংযত পদক্ষেপে স্তন্যদানরত
মাতার মতো শিশুকে যেন বুকে ধরিয়া বাহির
হইয়া গেল। তাহার পিছনে পিছনেই
কিষ্টো আসিয়া দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।
দারোগা প্রশ্ন করিলেন, এ তাঁবু তোমার?
সেলাম করিয়া কিষ্টো বলিল, জি, হুজুর।
–দেখব তাঁবু আমরা, মদ আছে কিনা দেখব।
মেলার ভিড়ের
মধ্যে শিশুকে বুকে করিয়া বেদেনী ততক্ষণে জলরাশির
মধ্যে জলবিন্দুর মতো মিশিয়া গিয়াছে।
শম্ভু গুম হইয়া বসিয়া ছিল, রাধিকা উপুড়
হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। শম্ভু
তাহাকে নির্মম প্রহার করিয়াছে। শম্ভু
ফিরিয়া আসিতে বিপুল
কৌতুকে সে হাসিয়া পুলিশকে ঠকানোর বৃত্তান্ত
বলিয়া তাহার গায়ে ঢলিয়া পড়িল, বলিল,
ভেল্কি লাগায়ে দিছি দারোগার চোখে।
শম্ভু কঠিন আক্রোশভরা দৃষ্টিতে রাধিকার
দিকে চাহিয়া রহিল, রাধিকার সে দিকে ভ্রূক্ষেপও
ছিল না, সে হাসিয়া বলিল, খাবা, ছেলে খাবা?
শম্ভু অতর্কিতে তাহার চুলের
মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে প্রহার করিয়া বলিল, সব
মাটি ক’রে দিছিস তু; উহাকে আমি জেহেল
দিয়ার লাগি, পুলিশে ব’লে এলাম, আর তু
করলি ই কাণ্ড!
রাধিকা প্রথমটায় ভীষণ উগ্র হইয়া উঠিয়াছিল,
কিন্তু শম্ভুর কথা সমস্তটা শুনিয়াই তাহার
মনে পড়িয়া গেল গত রাত্রির কথা। সত্যই, এ
কথা শম্ভু তো বলিয়াছিল! সে আর প্রতিবাদ
করিল না, নীরবে শম্ভুর সমস্ত নির্যাতন সহ্য
করিয়া উপুড়
হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আজ অপরাহ্ন হইতে এ তাঁবুতেও খেলা আরম্ভ
হইবে।
শম্ভু আপনার জীর্ণ পোশাকটা বাহির
করিয়া পরিয়াছে, একটা কালো রঙের চোঙার
মতো প্যান্টালুন, আর একটা কালো রঙেরই
খাটো হাতা কোট। রাধিকার পরনের
পুরনো রঙিন ঘাঘরা আর অত্যন্ত
পুরনো একটা ফুলহাতা বডিস। অন্য সময় মাথার
চুল সে বেণি বাঁধিয়া ঝুলাইয়া দিত; কিন্তু আজ
সে বেণিই বাঁধিল না, আপনার সকল প্রকার
দীনতা ও জীর্ণতার প্রতি অবজ্ঞায়
ক্ষোভে তাহার যেন লজ্জায়
মরিতে ইচ্ছা হইতেছিল। উহাদের
তাঁবুতে কিষ্টোর সেই বিড়ালির মতো গাল
মোটা, স্থবিরার
মতো স্থূলাঙ্গি মেয়েটা পরিয়াছে গেঞ্জির
মতো টাইট পাজামা, জামা, তাহার উপর
জরিদার সবুজ সাটিনের একটা জাঙ্গিয়া ও
কাঁচুলি ঢঙের বডিস। কুৎসিত মেয়েটাকেও যেন
সুন্দর দেখাইতেছিল। উহাদের জয়ঢাকের বাজনার
মধ্যে কাঁসা-পিতলের বাসনের আওয়াজের
মতো একটা রেশ শেষকালে ঝঙ্কার দিয়া উঠে।
আর এই কতকালের
পুরনো একটা ঢ্যাপঢ্যাপে জয়ঢাক, ছি-!
কিন্তু তবুও সে প্রাণপণে চেষ্টা করে,
জোরে জোরে করতাল পেটে।
শম্ভু বাজনা থামাইয়া হাঁকিল, ও-ই ব-ড়-বা-ঘ!
রাধিকা রুদ্ধস্বর কোনোমতে সাফ
করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, বড় বাঘ কি করে?
শম্ভু খুব উৎসাহভরেই বলিল, পক্ষীরাজ
ঘোড়া হয়, মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে, মানুষের
মাথা মুখে ভরে, চিবায় না।
সে এবার লাফ
দিয়া নামিয়া ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে খোঁচা দিল,
জীর্ণ বৃদ্ধ বনচারী হিংসক আর্তনাদের
মতো গর্জন করিল।
সঙ্গে সঙ্গে ও-তাঁবুর ভিতর হইতে সবল পশুর
তরুণ হিংস্র ক্রুদ্ধ গর্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল।
মাচার উপরে রাধিকা দাঁড়াইয়াছিল, তার
শরীর
যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। ক্রূর
হিংসাভরা দৃষ্টিতে সে ঐ তাঁবুর মাচানের
দিকে চাহিয়া দেখিল, কিষ্টো হাসিতেছে!
রাধিকার সহিত চোখাচোখি হইতেই সে হাঁকিল,
ফিন একবার!
ও-তাঁবুর ভিতর হইতে দ্বিতীয়বার
খোঁচা খাইয়া উহাদের বাঘটা এবার প্রবলতর
গর্জনে হুঙ্কার দিয়া উঠিল। রাধিকার
চোখে জ্বলিয়া উঠিল আগুন।
অল্প কয়টি লোক সস্তায় আমোদ দেখিবার
জন্য শম্ভুর তাঁবুতে ঢুকিয়াছিল। খেলা শেষ
হইয়া গেল, শম্ভু হিংস্র মুখ ভীষণ
করিয়া বসিয়া রহিল। রাধিকা দ্রুতপদে মেলার
মধ্যে বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই
সে ফিরিল কিসের একটা টিন লইয়া।
শম্ভু বিরক্তি সত্ত্বেও সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল,
কি উটা?
কেরাচিনি। আগুন লাগায়ে দিব উয়াদের তাঁবুতে।
পুরা পেলম নাই, দু সের কম রইছে।
শম্ভুর চোখ হিংস্র দীপ্তিতে জ্বলিয়া উঠিল।
সে বলিল, লিয়ে আয় মদ।
মদ খাইতে খাইতে রাধিকা বলিল, দাউ দাউ
ক’রে জ্বলবেক যখন! সে খিল খিল
করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে অন্ধকারের
মধ্যে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, ঐ
তাঁবুতে তখনো খেলা চলিতেছে। তাঁবুর
ছেঁড়া মাথা দিয়া দেখা যাইতেছিল,
কিষ্টো দড়িতে ঝুলানো কাঠের লাঠিতে দোল
খাইতে খাইতে কসরৎ দেখাইতেছে।
উঃ, একটা ছাড়িয়া আর
একটা ধরিয়া দুলিতে লাগিল!
দর্শকেরা করতালি দিতেছে।
শম্ভু তাহাকে আকর্ষণ করিয়া বলিল, এখুনলয়,
সে-ই নিশুত-রাতে!
তাহারা আবার মদ লইয়া বসিল।
সমস্ত মেলাটা শান্ত স্তব্ধ; অন্ধকারে সব
ভরিয়া উঠিয়াছে। বেদেনী ধীরে ধীরে উঠিল, এক
মুহূর্তের জন্য তাহার চোখে ঘুম আসে নাই।
বুকের মধ্যে একটা অস্থিরতায়, মনের
একটা দুর্দান্ত জ্বালায় সে অহরহ যেন পীড়িত
হইতেছে। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। গাঢ়
অন্ধকার থমথম করিতেছে। সমস্ত নিস্তব্ধ।
সে খানিকটা এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত
ঘুরিয়া আসিল, কেহ কোথাও জাগিয়া নাই।
সে আসিয়া তাঁবুতে ঢুকিল, ফস
করিয়া একটা দেশলাই জ্বালাইল, ঐ কেরাসিনের
টিনটা রহিয়াছে। তারপর
শম্ভুকে ডাকিতে গিয়া দেখিল, সে শীতে কুকুরের
মতো কুণ্ডলী পাকাইয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে।
তাহার উপর ক্রোধে ঘৃণায় রাধিকার মন ছি-
ছি করিয়া উঠিল। অপমান ভুলিয়া গিয়াছে, ঘুম
আসিয়াছে! সে শম্ভুকে ডাকিল না,
দেশলাইটা চুলের খোঁপায় গুঁজিয়া,
টিনটা হাতে লইয়া একাই বাহির হইয়া গেল।
ঐ পিছন দিক হইতে দিতে হইবে।
ওদিকটা সমস্ত পুড়িয়া তবে এদিকে মেলাটার
লোকে আলোর শিখা দেখিতে পাইবে। ক্রূর
হিংস্র সাপিনীর মতো সে অন্ধকারের
মধ্যে মিশিয়া শনশন করিয়া চলিয়াছিল।
পিছনে আসিয়া টিনটা নামাইয়া সে হাঁপাইতে আরম্ভ
করিল।
চুপ করিয়া বসিয়া সে খানিকটা বিশ্রাম
করিয়া লইল। বসিয়া থাকিতে থাকিতে তাঁবুর
ভিতরটা একবার দেখিয়া লইবার জন্য
সে কানাতটা সন্তর্পণে ঠেলিয়া বুক
পাড়িয়া মাথাটা গলাইয়া দিল। সমস্ত
তাঁবুটা অন্ধকার! সরীসৃপের
মতো বুকে হাঁটিয়া বেদেনী ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল।
খোঁপার ভিতর হইতে দেশলাইটা বাহির
করিয়া ফস
করিয়া একটা কাঠি জ্বালিয়া ফেলিল।
তাহার কাছেই এই যে কিষ্টো অসুরের
মতো পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। রাধিকার
হাতের কাঠিটা জ্বলিতেই লাগিল, কিষ্টোর
কঠিন সুশ্রী মুখে কী সাহস! উঃ,
বুকখানা কী চওড়া, হাতের
পেশিগুলো কী নিটোল! তাহার
আশপাশে ঘোড়ার খুরের দাগ-ছুটন্ত ঘোড়ার
পিঠে কিষ্টো নাচিয়া ফেরে! ঐ যে কাঁধে সদ্য
ক্ষতচিহ্নটা ঐ দুর্দান্ত সবল বাঘটার নখের
চিহ্ন! দেশলাইটা নিভিয়া গেল।
রাধিকার বুকের মধ্যটা তোলপাড় করিয়া উঠিল,
যেমন করিয়াছিল শম্ভুকে প্রথম দিন দেখিয়া। না,
আজিকার আলোড়ন তাহার চেয়েও প্রবল।
উন্মত্ত বেদেনী মুহূর্তে যাহা করিয়া বসিল,
তাহা স্বপ্নের অতীত, সে উন্মত্ত
আবেগে কিষ্টোর সবল বুকের উপর ঝাঁপ
দিয়া পড়িল। কিষ্টো জাগিয়া উঠিল, কিন্তু
চমকাইল না, ক্ষীণ নারী তনুখানি সবল
আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া বলিল, কে? রাধি–
তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়া রাধিকা বলিল, হ্যাঁ,
চুপ।
কিষ্টো চুমায় তাহার মুখ ভরিয়া দিয়া বলিল,
দাঁড়াও, মদ আনি।
না। চল উঠ, এখুনই ইখান থেক্যে পালাই চল।
রাধিকা অন্ধকারের মধ্যে হাঁপাইতেছিল।
কিষ্টো বলিল, কুথা?
–হু-ই, দেশান্তরে।
–দেশান্তরে? ই তাঁবুটাবু–
–থাক পড়্যা। উ ঐ শম্ভু লিবে। তুমি উয়ার
রাধিকে লিবা, উয়াকে দাম দিবা না?
সে নিম্নস্বরে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
উন্মত্ত বেদিয়া–তাহার উপর দুরন্ত যৌবন-
কিষ্টো দ্বিধা করিল না, বলিল, চল।
চলিতে গিয়া রাধিকা থামিল, বলিল, দাঁড়াও।
সে কেরাসিনের টিনটা শম্ভুর তাঁবুর উপর
ঢালিয়া দিয়া মাঠের ঘাসের উপর
ছড়া দিয়া চলিতে চলিতে বলিল, চল।
টিনটা শেষ হইতেই সে দেশলাই
জ্বালিয়া কেরাসিনসিক্ত ঘাসে আগুন
ধরাইয়া দিল। খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল–
মরুক বুড়া পুড়্যা।

0 comments:

About

This blog DOES NOT host any image and mp3 music. All the images and mp3s(music files) here are found freely available around the web. I make no guarantees or promises in my service and take no liability for my users actions. I am not affiliated nor claim to be affiliated with any of the owners of images and mp3s(music files) here. All the images and mp3s are copyright of their respective owners. If you have any clarifications to be made or If you find any contents in this site which you think can be offensive, contact me & the content will be removed or modified accordingly.