অনেকদিন আগের
কথা। কৃষ্ণা নদীর তীরে এক ছোট্ট গ্রামে রামদাস নামে একজন ধার্মিক ব্রাহ্মন বাস
করত। তার একমাত্র ছেলের নাম ছিল বিল্বমঙ্গল। তিনি তার ছেলেকে খুব যত্ন করে সেকালের
সমস্ত বিদ্যা, শাস্ত্র, ও ধর্মিয় আচার পালনাদি শিখিয়েছিলেন। তার ফলে বিল্বমঙ্গল
একজন দয়ালু, মৃদুভাষী, ধর্মভীরু ও নরম-মনের মানুষ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার এই
সুকুমার প্রবৃত্তি, এই মানবিক গুনগুলি তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
যৌবনে পা দিতে না
দিতেই সে তার মা বাবাকে হারাল। ফলে অল্প বয়সেই সে তার বাবার
অগাধ ধন সম্পত্তির মালিক হয়ে গেল। কাঁচা বয়সে প্রচুর কাঁচা পয়সা হাতে পাবার ফলে
বন্ধু বান্ধবের সংখ্যাও বাড়তে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে। সে অসৎসঙ্গে পরে গেল। রামদাসের
ছেলে বিল্বমঙ্গল অনেক কু-অভ্যাসের দাস হতে শুরু করল। একদিন এক ব্ন্ধুর পরামর্শে সে
সপারিষদে মহাহুল্লোরে চিন্তামণি নামে এক বারবনিতার নাচ দেখতে গেল। চিন্তামণির রূপ
যৌবন তাকে সম্মোহিত করল। কোন যুক্তিই তাকে বেঁধে রাখতে পারল না। সে তার দেহ, মন,
বিষয়-সম্পত্তি, পারিবারিক সম্মান, তার জাত-কুল-ধর্ম বিষর্জন দিল চিন্তামণিকে কাছে
পাবার জন্য। চিন্তামণিই হল তার একমাত্র চিন্তা, তার মনের মণি। সে চিন্তামণির দাস
হল।
এভাবে দিনের পর
দিন, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই সে চিন্তামণির ঘরে কাটাতে লাগল। কিন্তু একদিন তাকে
বাধ্য হয়েই সারাটা দিন বাড়িতে থাকতে হল। দিনটা ছিল তার বাবার মৃত্যু-বার্ষিকী।
বাড়িতে থাকলেও মন পরে রইল অন্য জায়গায়। খুবই অনিচ্ছা ও অন্যমনষ্কতার সঙ্গে সে
সেদিনের ক্রিয়া-কর্মাদি পালন করল। সন্ধ্যাবেলা যখন সব কাজ শেষ হল, উপস্থিত গুরুজন
স্থানীয়রা বললেন – “বাবা, আজকে আর বাড়ি থেকে কোথাও যেওনা। এমন একটা দিনে . . . .”
কিন্তু কে কার কথা শোনে! কথায় আছে না – ‘কামাতুরণম্ নভয়ম্ নলজ্জা’। সে সবার কথা
উপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়ল।
বিল্বমঙ্গল
এক ছুটে নদীতীরে পৌঁছল। চিন্তামণির বাড়ি যেতে হলে এ নদী তাকে পার হতেই হবে।
ভগবানেরও লীলা অপার। একে সন্ধ্যা পেরিয়ে আঁধার ক্রমশ জমাট হতে শুরু করেছে, তার উপর
ঘন মেঘের চাদর চারদিক আরো ঘোরালো করে তুলেছে। ঘন ঘন মেঘ গর্জন ও বজ্র পাতের সঙ্গে
তুমুল বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। এই দুর্যোগের মধ্যে কোন মাঝিই নৌকো খুলতে রাজী হল না।
বিল্বমঙ্গল তাদের অনেক টাকা, এমনকি তার গলার চেন ও হাতের আংটি খুলে দিতে গেলেও
তারা কিছুতেই তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজী হল না। এদিকে বিল্বমঙ্গলেরও তখন ঝোঁক
চেপে বসেছে। কোনোরকম কিছু চিন্তা না করে নদীর উত্তাল ঢেউ এ ঝাঁপ মারল সে। নদীতে তখন
একটা পচাগলা শবদেহ ভেসে যাচ্ছিল। সেটাকেই কাঠের গুঁড়ি ভেবে জাপটে ধরল সে ভেসে
থাকার জন্য। এভাবে যখন সে কোনোরকমে নদীর ওপারে অর্দ্ধ-উলঙ্গ ও দুর্গন্ধময় অবস্থায়
চিন্তামণির বাড়ির কাছে পৌঁছাল, তখন দেখল বাড়ির সব দরজা বন্ধ। কোথাও কোনো আলোও
জ্বলছে না। আসলে বিল্বমঙ্গলই আগের থেকে জানিয়ে রেখেছিল আজকের দিনে তার আসতে না
পারার কথা। ফলে চিন্তামণি সব দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সুখনিদ্রায়
মগ্ন ছিল। বিল্বমঙ্গল খুব জোরে জোরে হাঁক-ডাক শুরু করল। কিন্তু দরজা জানলা বন্ধ
থাকার জন্য ও প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন কেউ শুনতে পেল না। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোচ্ছটায় দেওয়াল
থেকে একটা দড়ি (সাপ) ঝুলতে দেখল সে। সেটা বেয়ে উপরে উঠে গেল।
চিন্তামণির ঘরে গিয়ে জাগিয়ে তুলল তাকে।
চিন্তামণি অবাক
হয়ে দেখতে লাগল তাকে। অর্দ্ধ-উলঙ্গ। সারা দেহ থেকে টপ টপ করে জল ঝড়ছে। পচা
দুর্গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। জিজ্ঞাসা করল তাকে, এই দুর্যোগের রাতে সে এল কিভাবে। বিল্বমঙ্গল
সব বলল – কাঠের গুড়ির কথা, দড়ির কথা। তখন সবে বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। চিন্তামণি
লণ্ঠন নিয়ে দেখল দেখল দড়িটা আসলে দড়ি নয়, একটা লম্বা বিষধর সাপ। আর তার এক চাকর
এসে খবর দিল, কাঠের গুড়িটা আসলে একটা শবদেহ। সব দেখে শুনে সে বিল্বমঙ্গলকে মৃদু
ভৎর্সনার সুরে বলল – “আজ না তোমার বাবার মৃত্যু বার্ষিকী! একটা দিন বাড়িতে থাকা
গেল না! দেখ, তুমি যা কান্ড করে এসেছ তাতে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা যে তুমি
আমাকে ভালবাস বা আমার এই শরীরটাকে খুব ভালবাস। কিন্তু আমার এই শরীর, এই সৌন্দর্য
সকালের শিশিরের মতই ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিন পর এই শরীর আর ঐ শবদেহর মধ্যে কোন
পার্থক্যই থাকবে না। কেন তোমার এই বিপুল ভালবাসা অপাত্রে দান করছ? তোমার এই
প্রেমস্রোতধারা একমাত্র সেই প্রেমসাগরই বুকে নিতে পারে। আমার প্রতি যে প্রেম তুমি
দেখিয়েছ তার অর্দ্ধেকও যদি তুমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দেখাতে তাহলে তুমি মোক্ষলাভ
করতে। যে সাময়িক সুখের জন্য তুমি ছুটে বেড়াচ্ছো তার পরিবর্তে চিরসুখ লাভ করতে।”
এক একটা কথা তার
গালে এক একটা চড় কষাল, চাবুক মেরে তার পিঠ ফালাফালা করে দিল। প্রতিটি কথা তার বুকে
শেলের মত বিঁধতে লাগল। চোখ থেকে অঝোরে জল ঝড়তে লাগল তার। নিমেষে এক বিপুল পরিবর্তন
এল তার মধ্যে। আজ সে নতুন করে চিনতে পারল নিজেকে। চিন্তামণিকে গড় হয়ে প্রনাম করতে
গেল সে, বলল – “তুমিই আমার গুরু। আমার চোখ খুলে দিয়েছ তুমি। চির কৃতজ্ঞ আমি তোমার
কাছে।” তারপর কাঁদতে কাঁদতে কৃষ্ণনাম করতে করতে সেখান থেকে রাস্তায় নেমে এল সে। সে
সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে কৃষ্ণের খোঁজে সাধনায় মগ্ন হল।
অনেকদিন সাধনার
পর সাধক বিল্বমঙ্গল কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে সারা দেশ ভ্রমনে বেড়িয়ে পরল। কিন্তু কথায় আছে না, স্বভাব যায় না মলে. . .। একদিন গঙ্গার এক ঘাটে উন্মনা হয়ে
বসে ছিল বিল্বমঙ্গল। সেই সময় ঐ নগরের এক বনিকের সুন্দরী স্ত্রী স্নান সেরে উঠে
আসছিল। তার অপরূপ রূপলাবণ্য চোখ ধাঁধিয়ে দিল বিল্বমঙ্গলের। সে মেয়েটিকে অনুসরণ
করতে লাগল। মেয়েটি কোনকিছু খেয়াল না করে বাড়ি পৌঁছে গেল। কিছুক্ষণ পর তার স্বামী
কোন এক কাজে বাইরে যাবার সময় দেখল সদর দরজার পাশে একজন অপরিচিত লোক বসে আছে। সে
বিল্বমঙ্গলকে তার নাম, ধাম ও আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করল। বিল্বমঙ্গল সব সত্য বিবরণ
দিয়ে বলল – “আপনার স্ত্রীর রূপমাধুর্যে আমি মুগ্ধ ও আকর্ষিত। আমার চোখ, আমার
মনপ্রাণ তাকে দেখবার জন্য পিপাসিত। ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন – দয়া করে তাকে একবার
ডেকে দেবেন? আমি প্রাণভরে আর একটিবার তাকে দেখতে চাই।” বিল্বমঙ্গল সবকিছু সত্য এত
অকপট ভাবে বলল যে তিনি এর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখলেন না। তিনি ভিতরে গেলেন ডাকতে। ভগবান
কিন্তু তার ভক্তের এই পুনঃঅধপতন মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বিল্বমঙ্গলকে তার ভুল
উপলব্ধি করালেন। বিল্বমঙ্গলের বিবেক জেগে উঠল। তার এই অশোভন আচরণের জন্য তার মন
অনুশোচনায় ভরে উঠল। রাগ, ঘৃণা ও লজ্জায় সে তার দুই চোখকে দোষী সাবস্ত করল। যখন সেই বনিকের স্ত্রী বাইরে এল, সে তখন তাকে দেখার পরিবর্তে তার কাছে গিয়ে
বলল – “মা, তোমার চুল বাঁধার দুখানি কাঁটা দিতে পার?” মেয়েটি কিছু না বুঝে তার
খোঁপা থেকে দুটো কাঁটা খুলে তার হাতে দিল। বিল্বমঙ্গল তার অপরাধী দুই চোখকে সাজা
দেবার জন্য কাঁটা দুটো নিয়ে তার দুচোখে আমূল বিদ্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই গাল
বেয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝড়তে লাগল। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বিল্বমঙ্গল
কৃষ্ণনাম করতে করতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে লাগল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এভাবে
বিল্বমঙ্গলের মনের সব গ্লানি তার রক্ত ও অশ্রুধারায় ধুয়েমুছে গেল।
এরপর
বিল্বমঙ্গলের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ভগবানের সাধন ও ভজন। তার পরমারাধ্যের
দর্শন ও সান্নিধ্যলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি ভুলে
অন্ধ বিল্বমঙ্গল কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হয়ে হরিনাম সংকীর্ত্তন করতে করতে এক গ্রাম থেকে
অন্য গ্রামে ঘুড়তে লাগল। ভগবান কিন্তু তার এই অন্ধ ভক্তকে ভুললেন না। এক গ্রামে এক
রাখাল ছেলের বেশে তার কাছে এল। তাকে খাওয়ালো, তার সেবা শুশ্রূষা করল। এই ভাবে প্রতিদিন ওই রাখাল ছেলের সান্নিদ্ধ লাভের ফলে তার উপর মায়া পরে গেল।
আবার এক রাখাল ছেলের মায়া-বন্ধনে বাঁধা পরার জন্য বিল্বমঙ্গলের বিবেক যখন একদিন
তাকে পীড়া দিচ্ছিল, তখন সেই রাখাল বালক এসে বলল তাকে – “বৃন্দাবন যাবে তো! আমি
নিয়ে যাব তোমাকে।” বৃন্দাবনে পৌঁছে দেবার পর যখন সে চলে যেতে চাইল,
বিল্বমঙ্গল তার দুহাত চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঐশ্বরিক তরঙ্গ তার দেহমনে ঢেউ তুলল।
সে বুঝতে পারল ভগবান তার সামনে এসে ধরা দিয়েছেন। সে তার চোখের জলে ভগবানের পা
ধুইয়ে দিল। ভগবান তার চোখে হাত বুলিয়ে দিতেই সে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল ও
চিরকালের জন্য ভগবানের আশির্বাদধন্য হয়ে থাকল।
বিল্বমঙ্গল তার
শেষ জীবনে অনেক ভজন গীত ও প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন। সেকালের রীতি অনুযায়ী
বিল্বমঙ্গল তার গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তার প্রথম গুরু চিন্তামণিকে নিয়ে
লিখেছিলেন।
0 comments:
Post a Comment